প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ
‘বৈদিক যুগ’ বলতে যদি আমরা ঋগ্বেদ ও বেদাঙ্গসূত্র-এর মধ্যবর্তী সময়কাল বুঝি, এবং যথাযথ বৈদিক যুগের সময়সীমা যদি সেটাই হয় তাহলে তার ব্যাপ্তি সতেরো থেকে আঠারোটি শতক।(১) অবশ্যই এই সময়ে নারীর অবস্থান আগাগোড়া এক ছিল না। ঋগ্বেদ-এর প্রাচীন অংশে আমরা দেখি, গ্রামকেন্দ্ৰিক যাযাবর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যতটুকু প্ৰত্যাশা করা যায়, নারী সেই মাত্রাতেই স্বাধীনতা ভোগ করছে।‘(২) নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নানা চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ঊষস অর্থাৎ ভোর এক রূপসী, সুসজ্জিত রমণী; তাকে সম্পূর্ণ বাধাহীন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: ‘শুচি ও সুন্দর ঊষস, রক্তবস্ত্ৰে সজ্জিতা যেন সদ্যস্নাত, মায়ের হাতে স্নেহভরে প্রসাধিতা এক কন্যা।’(৩) ‘হাস্যমুখী বধু যেমন স্বামীর সামনে নিজের রূপ উন্মোচিত করে তেমনি ঊষা তার রূপ উন্মোচিত করেন।‘(৪) এ ছাড়া তাকে নির্লজ্জাও বলা হয়েছে।(৫)এর থেকেই নারীর স্বাধীন বিচরণ বিষয়ে সমাজের বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু এই অংশটি ঋগ্বেদ রচনার অর্বাচীন সময়কার। ‘অগ্নি মানুষের স্তুতি তেমন ভাবেই উপভোগ করেন, যেমন ভাবে প্রেমিক পতি স্ত্রীকে উপভোগ করেন।’(৬) ‘আমাদের স্তুতি তোমাকে তেমনি ভাবে স্পর্শ করুক, যেমন ভাবে স্বামীর স্পর্শে স্ত্রীর কামনা জেগে ওঠে।’(৭) ‘অগ্নি স্বামীর দ্বারা সম্মানিত স্ত্রীর মতোই পবিত্র।’(৮) লক্ষ্য করা যেতে পারে, দেবতার পবিত্রতা মর্ত্য নারীর পবিত্রতার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। একের পর এক চিত্রকল্পে নারীর প্রতি প্রেম নিবেদনকারী পুরুষের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে ভক্তের ইষ্টদেবতার প্রতি আবেদনের।(৯) সূর্য উষার পিছনে পিছনে যান, যেমন পুরুষ যায় নারীর পিছনে। এমনকী পুরুষের প্রতি নারীর কামনাকেও খোলাখুলি ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।’(১০) সূর্য উষার উপপতি; ‘জারোন’–বারে বারে ব্যবহৃত এই অংশটির মধ্যে অবৈধ প্ৰণয়ের চিত্র বহুবার পাওয়া গেছে। পিতা ও কন্যার মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক নাভানেদিষ্ঠ সূক্তের বিষয়।(১১) ভাইবোনের মধ্যে এই সম্পর্ক বিখ্যাত যম-যমী সংবাদ সূক্তের বিষয়।(১২) ‘নদীগুলি বিশ্বামিত্রের দিকে যায়, যেমন নারী নত হয় চুম্বনোদ্যত পুরুষের দিকে।’(১৩) ‘যেমন প্রিয়া পত্নী প্রেমিক স্বামীর মধ্যে আনন্দ পায়, হে ভক্ত, তুমিও যেন আমার মধ্যে সেই আনন্দ পাও।’(১৪) আবার ভক্ত ও ইষ্ট দেবতার তুলনা করা হচ্ছে মনুষ্যমিথুনের সঙ্গে। ঘৃতের ধারা সোমের দিকে যায়, যেমন সুসজ্জিতা সুন্দরী তরুণী যায় স্বামীর কাছে।’(১৫) অবিবাহিতা নারী তার স্বামী বেছে নিতে পারে।(১৬) গৃহে তার কী কর্তব্য সে সম্বন্ধে প্রাচীন সাহিত্যে স্পষ্ট ভাবে কিছু বলা নেই, শুধু বলা হয়েছে সে জল আনত এবং ক্ষেতের দেখাশোনা করত।(১৭) শতপথ ব্ৰাহ্মণ-এ বলা হয়েছে, সে পশম পাকাত (এবং হয়তো বুনতও)।(১৮) অবশ্যই বাড়িতে আরও অনেক কাজ তাকে করতে হত। ঋগ্বেদ-এ নারীদের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করারও সাক্ষ্য আছে। তাই আমরা শুনি, মুদ্-গলিনীর যুদ্ধ জয়ের বৃত্তান্ত।(১৯) বিশ্পলা যুদ্ধে একটি পা এবং বধ্রিমতী একটি হাত হারান। বধ্রিমতী এবং শশীয়সী তাঁদের বীরত্বের জন্যও উল্লিখিত হয়েছেন। এর থেকে প্রাচীন বৈদিক যুগে নারীর কিছুটা সাম্য ভোগ করার সাক্ষ্য মেলে। দেবগণ ও পিতৃগণকে দৈনন্দিন জল দেওয়ার প্রসঙ্গে এমন তিন নারীর নাম পাই যাদের উদ্দেশ্যেও জল দেওয়া হত। তাঁরা হলেন গার্গী বাচক্লবী, বাড়বা আত্ৰেয়ী এবং সুলভ মৈত্ৰেয়ী।(২০) তাছাড়া বেদের ছয় অধ্যয়নের অন্তে উৎসর্গ দিবসে একটি অনুষ্ঠান হত; অন্যান্য শ্রদ্ধার্হদের মধ্যে বিশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতীকে আসন দেওয়া হত।